সালাতুল ইসতিসক্বা ~মুহাম্মদ মুনিরুজ্জামান সাফিন ||মুক্ত লিখনী||

 সালাতুল ইসতিসক্বা.....

খুব সম্ভব আমার বয়স তখন ৬ কি ৭ বছর। কেবল শৈশবের বারান্দায় হামাগুড়ি দেয়ার বয়স। সকালে সূর্য মামার আগে উঠে মক্তবে যাওয়াও শুরু করেছি তখন।ঠিক সালটা মনে নেই তবে এতটুকু খুব ভালভাবে স্বরণে আছে সময়টা গ্রীষ্ম কালের।  গরম আর তাপাদহে তখন পুরো গ্রামবাসীর হাসফাঁস অবস্থা।রৌদ্রের প্রখরতায় জমিন ফেটে চৌচির। অনাবৃষ্টিতে ফসলের বেহাল দশা। খড়ায় খাল-বিল, পুকুর-জলাশয়,নদী-নালা শুকিয়ে খা খা করছে। ফলে যেমন বেড়েছে জনজীবনের দূর্ভোগ তেমন হচ্ছে বিশাল অংকে ফসলের ক্ষতি।গ্রামের মুরব্বীরা বলাবলি করছিল এমন খড়া নিজের জন্মে দেখেনি তারা।

আমি তখন শৈশবে।  গরম কি আর খরা কি তার কি বা বুঝতাম!! সারাদিন খেলাধূলা আর ক্লান্ত হয়ে গেলে পুকুরে ঝাপাঝাপি,, এই ছিল রোজকার কাজকর্ম।  ঐ সময়টায় দাদী বেঁচে ছিলেন। আমাকে ঘর্মাক্ত অবস্থায় দেখলে কোলে বসিয়ে নিজ আঁচল দ্বারা মুখ মুছে দিতেন আর মাঝে মাঝে লেবুর শরবত বানিয়ে খাওয়াতেন।

দিনটি ভাল করেই মনে আছে আমার। সেদিন ছিল রবিবার। এলাকার মসজিদের ইমাম সাহেব গ্রামবাসীর কাছে "সালাতুল ইসতিক্বা'র" কথা বলল।নতুন নাম, খায় না মাথায় দেয় সেটাও জানি না। পড়ে বাবার কাছ থেকে জানতে পারলাম, এটি একধরনের নামাজ।  অনাবৃষ্টির কবল থেকে রক্ষা পেতে ঈদের নামাজের ন্যায়  খোলা ময়দানে এই নামাযটি পড়ে আল্লাহ তায়ালার দরবারে বৃষ্টি প্রার্থনা করতে হয়।

শরীয়াতের পরিভাষায়  সালাতুল ইসতিসক্বা বলা হয় 'পানির চরম সংকট,  অনাবৃষ্টি,  অতিখরার সময় ঈদের নামাজের ন্যায় নামাজ আদায় করে পানি প্রার্থনাকে '।সুনানে আবু দাঊদে  সহীহ্ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতুল ইসতিসক্বা আদায় করেছেন।

সেদিন বেলা ১১টার সময় ইমাম সাহেব গ্রামবাসীকে নিয়ে গ্রামের মাঠে সালাতুল ইসতিসক্বা আদায় করলেন।নামাজ শেষে অত্যন্ত করুন সুরে কেঁদে কেঁদে সকলে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করল। ইমাম সাহেবের ক্রন্দনরত সেই কন্ঠে ঝরে পড়া কথামালা এখনো কানে বাজে।

সেদিন বিকেলে ঘুমিয়ে ছিলাম এমন সময় বজ্রপাতের বিকট আওয়াজে ঘুম ভাঙে। বাইরে তাকিয়ে দেখি কালোমেঘে পুরো আকাশ ছেয়ে গেছে। গুরিম গুরিম শব্দে আসমান জমিন কেঁপে উঠছে। কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হল মুশধারে বৃষ্টি। সে কি বৃষ্টি।লম্বা একটা খরার পরিসমাপ্তির পর এই রহমতের বৃষ্টিতে সেদিন আমাদের পুরো গ্রাম সিঞ্চিত হয়েছিল। একটানা রাত পর্যন্ত অবিরাম বৃষ্টি চলল।  ভরে উঠল সমস্ত খাল-বিল পুকুর, নদী-নালা সবকিছু। রহমতের বারিধারায় সারা ধরনী সেদিন নেচেছিল আনন্দ মিছিলে।

যদিও তখন অত কিছু বুঝতাম না তবে একটুকু ঠিকই বুঝে নিয়েছিলাম যে, খালেস নিয়তে সহীহ আক্বীদায় প্রভুর দরবারে বিনয়ের সাথে চাইলে আল্লাহ দিতে দেরি করেন না। আমাদের প্রিয় নবী'র (সাঃ)দেখানো পথে অগ্রসর হয়ে প্রভুর সামনে চোখের পানি ফেললে তা পাওয়া শুধু সময়ের ব্যপার।

তাছাড়া এই আমলটি আজ বিলুপ্তপ্রায়। গরম আর তাপদাহে নাভিস্বাশ ছুটলেও আমরা অগ্রসর হইনা সালাতুল ইসতিক্বা পড়তে। পানি উত্তোলন  এবং সেচ ব্যবস্থার আধুনিকায়নে পানি হয়েছে সহজলভ্য ফলে ভুলে গিয়েছি আমরা পানির কদর। আমাদের অন্তরে ছেয়ে গেছে খোদা বিমুখতা।সমস্ত চাওয়া-পাওয়া  আল্লাহর দরবারে পেশ করার ইচ্ছাশক্তি আমরা হারিয়ে ফেলেছি। অথচ প্রিয়নবী (সাঃ)নিজে কাজেকর্মে আমাদের এই আমলগুলো শিখিয়ে গিয়েছেন।

আসুন আমরা আনন্দ-বেদনা  সবকিছু আল্লাহর সাথে ভাগাভাগি করি। সমস্ত দাবী-দাওয়া   আল্লাহর নিকট পেশ করি। সুখে-দুঃখে আল্লাহর চরণে আরজি জানাই। আল্লাহর রহমতকেই আমাদের ভরসা বানিয়ে ফেলি। তাহলে ডুবতে হবে না কখনোই নিরাশার সাগরে


লেখকঃ 

মুহাম্মদ মুনিরুজ্জামান সাফিন 




Comments

  1. Replies
    1. ধন্যবাদ সুপ্রিয় ভাই আমার। দোয়া ও মোনাজাতে স্বরণ রাখবেন এই কামনা করছি ।

      Delete
  2. অনেক অনেক দোয়া ও ভালোবাসা সাফীন ভাই!
    সত্যিই কথাগুলো সত্য ও অসাধারণ।

    ReplyDelete
  3. চমৎকার প্রকাশ!!
    ঘুরে আসতে পারেন আমার ওয়েবসাইট থেকে। http://smallpoete.blogspot.com

    ReplyDelete

Post a Comment